৩০ জানুয়ারী, ২০১১

'মেহেরজান' চলচ্চিত্র নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রতিক বিতর্ক ও কিছু কথা

আপনি যদি এই ব্লগের নতুন পাঠক হন আর পরবর্তী সকল নতুন পোস্ট দ্রুত পেতে চান
তাহলে সাবস্ক্রাইব করুন RSS Feed !
'মেহেরজান'; যুদ্ধ ও প্রেমের গল্প নাম দিয়ে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি চলচ্চিত্র। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সহযোগীতায় মুক্তিপ্রাপ্ত এই ভিন্নস্বাদের (!) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রটি নিয়ে মুক্তির আগে থেকেই মিডিয়া মারফত ব্যাপক মাতামাতি চলেছে। হয়েছে নানা আলোচনা, ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সহযোগীতায় এর আগে বেশকিছু সাড়াজাগানো মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি তৈরি হওয়ায় এই ছবিটি নিয়েও সৃষ্টি হয়েছিল দর্শক-বোদ্ধাদের আগ্রহ। এই ছবিতে ভারতের জয়া বচ্চন, ভিক্টর ব্যানার্জীর মত গুণী শিল্পীদের অভিনয়ের কথা শুনেও আগ্রহী হয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু মুক্তির পর কি দেখলাম আমরা এই ছবিতে?
ভিন্নধারার গল্পের নাম দিয়ে এই ছবিতে দেখানো হলো আমাদের জাতির গর্ব মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চরম বিতর্কিত আর বিকৃত ইতিহাস! সচেতন জনগণ এটি মেনে নেয় নাই, কিছু মিডিয়া আর ব্যক্তি এটিকে সমর্থন দিলেও দেশের বেশিরভাগ জনগণ এই ছবিটি নিয়ে সমালোচনা করেছেন, অনলাইন জগতে ব্লগ-ফোরাম সহ সবখানে চলেছে এই ছবিটির ব্যবচ্ছেদ আর তুমুল সমালোচনা।
বেশকিছু মিডিয়াতেও আলোচিত হয়েছে এই ছবিটিতে দেখানো বিকৃত ইতিহাস। বিশেষ করে যখন দেশে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী' বলে পরিচিত সরকার ক্ষমতাসীন তখন এধরনের একটি ছবি কিভাবে সেন্সর সার্টিফিকেট পেলো বা কিভাবে এটি মুক্তি পেলো সেটি নিয়েও নানাজনে প্রশ্ন তুলেছেন।

filmposter@muktoabhi.co.cc


কেন এই বিতর্ক?
ছবিটির কাহিনীটিই বিতর্কিত। এই ছবির উপাদান, সংলাপ, ঘটনাপ্রবাহ সহ নানাকিছু বিশ্লেষন করে দেখা গেছে এই ছবিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে তা পুরাপুরি মনগড়া ও বিকৃত তথ্যনির্ভর। এই ছবিতে বিতর্কের প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
১. যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে যখন পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে মানুষ মারা যাচ্ছে ও নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে একজন এদেশীয় তরুনীর সাথে এক পাকসেনা অফিসারের অবাধ প্রেমের চিত্রায়ন!
২. ১৯৭১ সালের মানুষের মুখেও বর্তমানের তথাকথিত মর্ডান (!) সময়ের অনুকরনে 'খাইতাসি' 'যাইতাসি' 'আমি তোমাকে জেনুইনলি ভালোবাসি' টাইপের সংলাপ।
৩. ছবিতে বারবার আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের ভুলভাবে উপস্থাপন ও একজন পাকসেনাকে নায়কের ভূমিকায় রেখে সমান্তরালে সুকৌশলে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভিলেন হিসাবে উপস্থাপন।
৪. যুদ্ধের চেয়ে প্রেমকে বড় করে দেখা, শান্তির বানী ইত্যাদির নামে মুক্তিযুদ্ধকে অসার ও অপ্রয়োজনীয় বলে প্রমাণের অপপ্রয়াস।
৫. রাজনৈতিক ভুল তথ্য প্রদান ও সেইসময়কার মানুষের মানসিক পরিস্থিতি ও পটভূমির সামগ্রিক মনগড়া চিত্র উপস্থাপন।
এছাড়াও ছবিতে ব্যবহৃত পোশাক পরিকল্পনা, বেশিরভাগ চরিত্রের দূর্বল অভিনয় সহ আরো নানাকিছু নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে যা আপনারা অনেকেই পত্রিকা ও অনলাইন জগত মারফত হয়তো জেনে থাকবেন।
এই ছবিটির রিভিউ ও এই সম্পর্কিত লিখা প্রায় সকল ব্লগ/ফোরামে প্রকাশিত হয়েছে, ফলে আমি সেদিকে না গিয়ে এই ছবিটি নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু মতামত দিতে চাই।
ছবিটির কাহিনীর উৎস কি?
ছবিটির পরিচালিকা রুবাইয়াত হোসেনের ভাষ্যমতে তিনি আমেরিকার পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বীরাঙ্গনা নারীদের নিয়ে গবেষনা করার সময়েই এই কাহিনী লিখেছিলেন। এছাড়াও তিনি রেফারেন্স দিয়েছেন নীলিমা ইব্রাহিমের 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' গ্রন্থের ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষীনির। কিন্তু তার ছবিটির কাহিনীর সাথে উনার দেওয়া সকল রেফারেন্সই সাংঘর্ষিক, নীলিমা ইব্রাহিমের গ্রন্থের মেহেরজান আর উনার দেখানো মেহেরজানের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক ও এছাড়া ফেরদৌসী প্রিয়ভাষীনির জীবনের যে ঘটনাটি থেকে তিনি তথ্য নিয়েছেন সেটির সাথেও উনার কাহিনীর কোন মিল নেই। আর উনি গবেষনালব্ধ কি তথ্য-উপাত্ত এতে দেখিয়েছেন তা নিয়ে বলাই বাহুল্য!
তার ছবিটি দেখে বারবার মনে হয়েছে হার্ভাডের গবেষক বলে পরিচিত বিতর্কিত শর্মিলা বসুর সেই ঘৃনিত গবেষনা পত্র/প্রবন্ধটি দ্বারা অনুপ্রানিত যেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে স্রেফ একটি গৃহযুদ্ধ হিসাবে উপস্থাপন করে বীরাঙ্গনার সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন সেই গবেষক। আমাদের এই তরুন পরিচালিকা নিজেও ঠিক সেই ধরনের কিছুই গবেষনা করেছিলেন কি না সেটি নিয়েও অনেকে বলছেন। এইজন্য সচলায়তনের এক ব্লগার উনাকে '২য় শর্মিলা বসু' হিসাবেও আখ্যায়িত করেছেন। উনি এই ছবিটিকে একটি ফ্যান্টাসি আর যুদ্ধ-প্রেমের গল্প বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রথম-আলোতে প্রকাশিত তার প্রতিক্রিয়ায়। কিন্তু সচেতন দর্শক মাত্রই দেখেছে প্রেম-ফ্যান্টাসি-যুদ্ধের নাম দিয়ে ইতিহাসকে কিভাবে বিকৃত করা হয়েছে এই ছবিতে।
পরিচালিকা নিজে সরকারের এক মন্ত্রীর মেয়ে জেনে অনেকেই বেশ নড়েচড়ে বসেছেন। এখন প্রশ্ন হলো- এই ছবির কাহিনী দেখে অন্যদেশের কেউ যদি প্রশ্ন করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তখন কি জবাব দিবো আমরা? এটিই কি ছিল যুদ্ধকালীন এদেশীয় নারীদের মনোভাব? বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর এক সদস্যকে এই ছবিতে রোমান্টিক-প্রকৃতিপ্রেমী হিসাবে উপস্থাপন করে কি বার্তা দিতে চেয়েছেন পরিচালিকা? এরকম হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে দর্শকদের এই ছবিটি দেখতে গিয়ে।
সবমিলিয়ে এই ছবির কাহিনীটির উৎস ঘোলাটে ও কোন বিবেচনাতেই এটিকে ইতিহাস বিকৃতি বা মনগড়া ছাড়া অন্যকিছু ভাবার কোন অবকাশ নেই।

আপনারা হয়তো ইতিমধ্যেই জেনে থাকবেন এই ছবিটির প্রদর্শনী ইতিমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছে এর পরিবেশক আর্শীবাদ চলচ্চিত্র। এই সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এখনো সরকার বা তথ্য মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাইনি। এর কারন কি? মন্ত্রীর মেয়ে বলেই কি কোন প্রতিক্রিয়া নেই? অন্য কোন ভিন্ন মতাবলম্বী পরিচালক হলে কি উনার বিরুদ্ধে 'যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র' টাইপের কোন অভিযোগ আনা হতো না? দেশের সচেতন জনগণ এই ছবিটি নিষিদ্ধ হোক এটা দেখতে চায়। এই ব্যাপারে আমাদের সকলেই সরকারের তরফ থেকে আশু কোন পদক্ষেপ দেখতে চাই। সেইসাথে সেন্সর বোর্ডের যেসব ব্যক্তিরা এই ছবিটিকে ছাড়পত্র দিয়েছিলেন তাদের বিষয়েও কোন পদক্ষেপ নিতে হবে। কিসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উনারা বিনা প্রতিবাদে এই ছবিকে ছাড়পত্র দিয়েছিলেন তা খতিয়ে দেখা দরকার। অনেকে বলছেন মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যের ছবি এবং ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সুনাম বিবেচনা করেই নাকি এই ছবিটি সেন্সর পেয়ে গেছে। কিন্তু এটি ছাড়া আর কি কোন কারন আছে কি না সেটাও ভেবে দেখা দরকার।

পরিশেষে বলতে চাই, এই ছবিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের খাটো করে দেখানো হয়েছে, এই ছবিটির মত ছবি একটি বিশেষ শ্রেনীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র বলেই মনে হয়েছে। আমাদের দেশে এমনিতেই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবির সংখ্যা বেশ অপ্রতুল, আমরা চাই বেশি করে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ছবি তৈরি হোক, কিন্তু তাই বলে এমন ছবি আমাদের কারো কাম্য নয়। এই ছবিটি কোনভাবেই আমাদের নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ধ্যান-ধারনার প্রকাশ নয় বা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাধারন মানুষের চিন্তাভাবনার প্রতিফলনও এই ছবিতে নেই। মেহেরজানের মত ছবির মুক্তি ও প্রদর্শন কেবল আমাদের মাথা হেঁট করে দিবে। তাই অবিলম্বে এই ছবিটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছি। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি হলেও সেন্সর বোর্ডে এর কাহিনী বিচার-বিশ্লেষন করে দেখার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করছি। নইলে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নাম দিয়ে এভাবেই মনগড়া বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করা হবে আমাদের নতুন প্রজন্ম ও বিশ্ববাসীর সামনে। ইতিহাস বিকৃতির ঘৃণ্য খেলা আমরা অতীতেও অনেক দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নোংরা রাজনীতিও দেখেছি। আমরা আর এমন কিছু চাই না। নতুন প্রজন্ম হিসাবে আমাদের সবার দাবি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক নিরপেক্ষ ইতিহাস সবার সামনে তুলে ধরা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে 'মেহেরজান' চলচ্চিত্রের মত বিতর্ক যাতে ভবিষ্যতে আর না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।


3 মন্তব্য:

ইরতেজা আলী বলেছেন...

আমি এখনো ছবিটি দেখি নি। তবে আর দেখার ইচ্ছাও নেই। এই রকম ছবি যাতে আর কোন দিন নির্মিত না হয়। ছবির পারিচালিকার উচিত ক্ষমা চাওয়া।

ভালো ব্লগ বদ্দা। আপনার লেখা খুবি নির্ঝর।

অভি বলেছেন...

ধন্যবাদ বদ্দা :)
এই ধরনের ইতিহাস বিকৃতির ছবি নিয়ে আমাদের সবার সচেতন থাকা দরকার। আমাদের নতুন প্রজন্ম এধরনের ছবি বয়কট করলে ভবিষ্যতে কেউ এমন ছবি নির্মানের ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পাবেনা বলে মনে করি।

রনি বলেছেন...

ছবিটি নিষিদ্ধ করার দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি...

মন্তব্যে ইমোটিকন ব্যবহারের জন্য ইমোটিকনের পাশের কোডটি আপনার কি-বোর্ডের সাহায্যে টাইপ করুনঃ
:)) ;)) ;;) :D ;) :p :(( :) :( :X =(( :-o :-/ :-* :| 8-} :)] ~x( :-t b-( :-L x( =))

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন