৩ মার্চ, ২০১২

ব্লগ সমাজ বদলের হাতিয়ার, তাহলে কেন এত অনীহা?

আপনি যদি এই ব্লগের নতুন পাঠক হন আর পরবর্তী সকল নতুন পোস্ট দ্রুত পেতে চান
তাহলে সাবস্ক্রাইব করুন RSS Feed !
বাংলা ব্লগিং জগতে আমার পদার্পণ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিকে, সালটা ২০০৮, শুরু থেকেই ব্লগে অন্যদের লিখা পড়তে ভালো লাগতো, তবে সরাসরি ব্লগে তেমন বেশি কিছু লিখা হয়নি, মূলত প্রযুক্তিবিষয়ক ফোরামগুলোতেই ছিলো আমার নিয়মিত পদচারণা। যেহেতু প্রযুক্তি বিষয়ে অধ্যয়নরত আছি সেহেতু প্রযুক্তি বিষয়ক ফোরাম ও ব্লগগুলোই আমাকে বেশি টানতো। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শণের সংস্পর্শে এসে আমার আগ্রহ জন্মালো রাজনীতি এবং সমাজনীতি বিষয়ে। তবে বাংলা ব্লগগুলোর পরিবেশ ও ব্যক্তিগত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি এড়িয়ে চলার জন্য এসকল বিষয়ে লিখালিখি এড়িয়ে চলতাম। শুধু পড়েই ভালো লাগতো।

ব্লগিংকে সবসময়ই আমি মনে করি সমাজ বদলের হাতিয়ার, আধুনিক সমাজে বিক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্ম নিজেদের ক্ষোভ ও দাবিগুলো অনলাইনে ফুটিয়ে তুলে ব্লগের মাধ্যমেই। শাসকের শোষণ ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তারুণ্যের দৃপ্ত উচ্চারণ একেকটি ব্লগ পোস্ট। ব্লগের ভূমিকা ব্যাপক, দেশের চলমান রাজনীতি, অর্থনীতি সহ নানা বিষয়ে মানুষের বিশেষত দেশের তরুণ প্রজন্মের ভাবনাগুলো আমরা জানতে পারি ব্লগগুলোর মাধ্যমেই। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত আরব বসন্তে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন উক্ত দেশগুলোর ব্লগার সমাজ সহ তরুন প্রজন্মরাই। তাই নানাসময়ে প্রতিবাদী ব্লগার ও ব্লগগুলোর উপরে নেমে এসেছে শাসকের উৎপীড়ণ। নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে ব্লগের সাহসী ব্লগার ভাইদের। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

 ব্লগ নিয়ে এত কথা বলার কারণ মূলত একটি ব্যক্তিগত দুঃখজনক অভিজ্ঞতা শেয়ার করা।

বাংলা ব্লগ সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া (বিশেষত যারা CSE, EEE সহ প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহে অধ্যয়নরত) ছাত্রছাত্রীদের মনোভাব যাচাইয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমি নিজে কিছু ছাত্রছাত্রীর সাথে কথা বলি। এতে একটি হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠে আমার সামনে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যেই বাংলা ব্লগগুলো সম্পর্কে অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে।

এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী বাংলা ব্লগগুলো ভিজিট করেন ও টুকটাক মন্তব্যও করেন। এদের মতে বাংলা ব্লগগুলোর পরিবেশ কোন কোন ক্ষেত্রে খুবই খারাপ। মানসম্পন্ন ও যুক্তিপূর্ন লিখার চেয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, কুরুচিপূর্ন কৌতুক, অশ্লীল ছবি ব্লগ এসবের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সমকালীন সমস্যাগুলো নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরার বদলে অনেক ব্লগারকেই দেখা যায় আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক, তথাকথিত ১৮+ জোকস ইত্যাদি বিতর্কিত বিষয়ে সময় ব্যয় করতে। ব্লগগুলোতে এদের দৌরাত্ম্যের কারনে অনেকে বাংলা ব্লগগুলোকে এড়িয়ে চলার কথা জানালেন।

আরেকদল শিক্ষার্থী ব্লগিং প্লাটফর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ন অজ্ঞ! এদের মতে ব্লগিং করে নষ্ট করার মত সময় শিক্ষাজীবনে নেই। 'পড়াশুনার সময় লস করে কি দরকার ব্লগে ফাউল প্যাচাল পারা', 'ব্লগে যাওয়া মানেই গালি খাওয়া', 'বাংলাদেশে কোন ভদ্রলোকে ব্লগিং করে নাকি?' এসব নানাবিধ মন্তব্য এরা করেছে। অনেকে আবার সঠিকভাবে প্রথম সারির কিছু বাংলা ব্লগের নামও বলতে পারেনি! অথচ এরা মেধাবী শিক্ষার্থী এবং প্রযুক্তি বিষয়ে অধ্যয়নরত!

যারা ব্লগিং সম্পর্কে আগ্রহী তারা নিজেদের ব্যক্তিগত ব্লগে লিখাটাই বেশি পছন্দ করেন। বাংলা ব্লগগুলোতে আসার ব্যাপারেও দেখা গেছে এদের অনীহা (অনেকটা আমার প্রথমদিককার মনোভাবের মত)।

আবার অনেক শিক্ষার্থী বাংলা ব্লগে লিখেন না কারন উনারা ভাবেন বাংলায় লিখে ভাব মারা যায়না! উনারা বিদেশী (ইংরেজি ভাষা) ব্লগ, ফোরামগুলোতে লিখেন আর নিজেদের ভাব বাড়ান! এমন অনেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ব্লগটিও থাকে ইংরেজি ভাষায়। আবার অনেকের মতে এতে ভিজিটর বেশি পাওয়া যাবে (এর অন্যতম কারন যে গুগল এডসেন্স ও পিটিসির মত বিষয় তা সহজেই বোধগম্য)। অর্থাৎ বিদেশী ভাষার ব্লগে ইংরেজি গালাগালি খেলেও সই! কিন্তু নিজের ভাষার ব্লগে এসে লিখলে 'স্ট্যাটাস' মেইনটেইন করা এদের কাছে দুষ্কর হয়ে পড়ে  ;)


এই হলো আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফলাফল। এখন বাংলা ব্লগিংয়ের প্রতি এই যে অনীহা তার অন্যতম কারন হিসাবে আমি চিহ্নিত করেছি নিম্নলিখিত কিছু বিষয়কেঃ-

১. ব্লগিং সম্পর্কে অজ্ঞতা
২. বাংলা ব্লগগুলোর বর্তমান পরিবেশ
৩. বাংলা ভাষায় লিখালিখির প্রতি অনীহা ও বিদেশী ভাষাপ্রীতি
৪. ব্লগিং মানে সময়ের অপচয়- এধরনের নানাবিধ ধারনা পোষণ
৫. কোন কোন ক্ষেত্রে সিনিয়র বড়ভাই ও শিক্ষকগণ কর্তৃক ব্লগিংয়ের মত বিষয়কে অনুৎসাহিত করা।
৬. কতিপয় শিক্ষার্থীর কেবল প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিষয়েই ডুবে থাকা ও রাজনীতি, সমাজনীতি সহ দেশের চলমান নানা বিষয়ে অনাগ্রহ।


এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে কেন মেধাবী শিক্ষার্থীদের এত অনাগ্রহ বাংলা ব্লগিংয়ের প্রতি? প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশুনা করলেও কেন ব্লগিংয়ের মত এত বিশাল প্লাটফর্মের প্রতি একধরনের ছুৎমার্গ কাজ করছে এদের মনে? এজন্য কি আমাদের বাংলা ব্লগগুলোর পরিবেশ দায়ী?

বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মতেই ব্লগগুলোর নোংরা পরিবেশের কারনেই এরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে দিন দিন। এর দায় এড়াতে পারবেনা ব্লগসমূহের ব্লগার সহ কর্তৃপক্ষ। প্রতিটা ব্লগেই নীতিমালা রয়েছে বড় সাইজের, কিন্তু কয়টি নীতিমালা মেনে চলা হয়? বা নির্দিষ্ট কিছু ব্লগার দিনের পর দিন ব্লগের পরিবেশ নষ্ট করে চললেও কেন এদের কঠোরভাবে দমনের পরিবর্তে তোষণ করা হয়?

এই বিষয়ে সচেতন ব্লগারসহ মহামাণ্য ব্লগ এডমিন এবং মডারেটরদের ভূমিকা প্রধান বলে আমি মনে করি। এরা নিঃসন্দেহে সচেতন শিক্ষিত মানুষ, তাহলে কেন এনারা পারবেননা মেধাবী মুখগুলোকে ব্লগমুখি করতে? ব্লগের পরিবেশ সুন্দর রাখার মাধ্যমে মেধাবী যুক্তিবাদী তরুণদের ব্লগের প্রতি আকর্ষণ করতে পারবেন এরাই। নয়তো একদিন হুমায়ূন আজাদের ভাষায় 'সবকিছু চলে যাবে নষ্টদের দখলে' কিন্তু আমরা কি তা হতে দিতে পারি? সমাজ বদলের হাতিয়ার যে ব্লগ, তরুণ সমাজের প্রতিবাদের ভাষা যে ব্লগ, সুন্দর মতপ্রকাশের মাধ্যমে স্বাধীন চিন্তাচেতনার স্ফূরণ ঘটায় যে ব্লগ সেই ব্লগ আমরা নষ্টদের দখলে যেতে দিতে পারিনা।

আর ব্লগবিমুখ তরুণ সমাজের প্রতি আমার আহবান, এসো সবাই মিলে ভেঙ্গে দিই সমাজের যত অনিয়মের অচলায়তন। ব্লগে এসে নিজেদের মতামত প্রকাশ করি, নষ্টদের দখলে চলে যেতে থাকা ব্লগগুলোকে সুন্দর, মননশীল লেখনী দিয়ে করে তুলি সত্যিকার সমাজ বদলের হাতিয়ার। কুয়োর ব্যাঙের মত কেবল একটা বিষয় নিয়েই পড়ে থাকার মধ্যে কোন স্বার্থকতা নেই, এর পাশাপাশি ভাবতে হবে দেশ ও সমাজকে নিয়ে। তরুণ সমাজরাই পারে দেশের যত অনিয়ম ও অবিচারের বিরুদ্ধে নিজেদের লিখার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে। দেশের উপর আসা যেকোন আঘাতে প্রথম মাঠে নামতে হবে আমাদের তরুন সমাজকেই। ফলে এই বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই।


পরিশেষে বলতে চাই, আমার এই লেখনীর উদ্দেশ্য কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করা নয়, বরং বাংলা ব্লগগুলো সম্পর্কে আমাদের দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্মের একটি অংশের মনোভাব তুলে ধরা। এদের ব্লগমুখি করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরকেই।

0 মন্তব্য:

মন্তব্যে ইমোটিকন ব্যবহারের জন্য ইমোটিকনের পাশের কোডটি আপনার কি-বোর্ডের সাহায্যে টাইপ করুনঃ
:)) ;)) ;;) :D ;) :p :(( :) :( :X =(( :-o :-/ :-* :| 8-} :)] ~x( :-t b-( :-L x( =))

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন